Wednesday, 30 September 2020

সরকার ভিলা দুর্গোৎসব

 পুজো আসলেই বন্ধুবান্ধবদের  মধ্যে  আলোচনা শুরু হয় এবার পুজোয় কার কি প্ল্যান ? কেউ  বলে সারারাত ঠাকুর দেখতে যাব , কেউ বলে ঘুরতে যাবো কলকাতার  বাইরে ।  আর  আমায়  কেউ বললে  আমি হেসে শুধু বলি আমার বাড়িতে  পুজো হয়। ব্যাস তখন সবাই স্বীকার করে নেয় বাড়ির পুজোর কাছে বাকি সব আনন্দ কিছুই না। আসলে বাড়ির  পুজোর যে কি মজা , লিখে প্রকাশ করা যায় না। তাই প্রতি বছর  পুজোর আনন্দের কথা  উঠলে আমার  শুধু  আমাদের   বাড়ির  পুজোর কথা  মনে আসে ।

                          



আমাদের বাড়ির পুজোর ইতিহাস অনেকটা গল্পের মতোই। মায়ের স্বপ্নাদেশ  পেয়ে  বাংলাদেশের  ঢাকার  বিক্রমপুরে  আমাদের পরিবারে দুর্গাপুজোর সূচনা  হয় ১৯৪০ সালে আমাদের পরিবারের প্রাণপুরুষ সুঁরেন্দ্রমোহন সরকারের  হাত ধরে। আর তারপর দেশভাগের পর  পরিবারের সদস্যরা  হুগলী জেলার  সোমড়াবাজারের যশড়া গ্রামে এসে বসবাস শুরু করেন এবং দেশ ভাগের জন্য  আর্থিক অনটনের কারণে পুজো  বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় কিন্তু আবার মায়ের  স্বপ্নাদেশ পেয়ে  এই সোমড়া বাজারে  বাড়ির সামনে  খোলা মাঠে  বাঁশের খুটি  ও  শাড়ির  বেড়া ও   হ্যাজাকের আলো জ্বালিয়ে পুনঃরায় পুজো শুরু হয়। সেই থেকে আজও  ওই  স্থানেই  মায়ের  পুজো  হয়ে  আসছে পরম্পরা  মেনেই।অনেকের সাহায্য আমাদের পুজোকে অনেকাংশে এগিয়ে নিয়ে চলেছে আজও। আমরা কেউই  পরিবারের সদস্যরা  সোমড়াবাজারে  সারাবছর থাকি না। শুধুমাত্র পুজোর ৫ দিন ও কিছু  বিশেষ কারণ ছাড়া সোমড়াবাজারে যাওয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না।আমাদের বাড়ির পাশে দত্তবাড়ি সম্পর্কে আমার দাদুর বাড়ি সারাবছর ওনারাই  আমাদের বাড়ি দেখেশুনে রাখেন। পুজোর  দিনগুলি পরিবারের কারোরই  কলকাতাতে  থাকা  হয়  না। আমাদের  কাছে  পুজো মানেই  আমাদের বাড়ির  পুজোই সেরা।
                                       
পুজোর সময়  হলেই  ছোটবেলায়  আমাদের  খুব   আনন্দ হতো  সোমড়াবাজার যাবো শুনলেই । ষষ্টীর দিন  সকাল ৬ টায়  বাড়ি থেকে বেড়িয়ে শিয়ালদা স্টেশানে  যাওয়া। পুজোর সময় শিয়ালদা স্টেশানের বাইরে হাজার ঢাকিরা এক সাথে ঢাক বাজাতো যেটা এখনও গেলে দেখতে পাওয়া যায়। সেই ঢাকের তাল শুনতে শুনতে নমে একরাশ আনন্দ নিয়ে স্টেশানের  ভিতর পৌছে  খুব কম করে ৩০ থেকে ৩৫ জন  আমাদের পরিবারের আত্মীয়দের  সাথে দেখা হতোই । তারপর সবাই এক জায়গায় দাড়ানো হতো ও টিকিট বড়ো কেউ কেটে আনতো ব্যাস  তারপর  কাটোয়া লোকাল যা আগে  সালার  নামে খ্যাত ছিল। সেই  ট্রেনে সবাই মিলে  একটি  কামরাতে উঠে  পড়া হতো ।  ট্রেনের কামরাতে  যে  দিকে তাকাতাম শুধু  আমাদের   বাড়ির  লোকজন  দেখতে jপেতাম । খুব  আনন্দ হতো  জানলার ধারে  বসে  শিয়ালদা থেকে  সোমড়াবাজার  যাওয়া । খুব  বেশি  না  ট্রেনে মাত্র ৩ ঘন্টার পথ ।  সেই  যাত্রাতে কি না হতো তখন  গান, গল্প, আড্ডা খাওয়া দাওয়া ও হাসাহাসি করতে করতে   সোমড়াবাজার স্টেশান  এসে পড়তো  আর  স্টেশানে  আমাদের  এক দাদু দাঁড়িয়ে থাকতেন  এবং স্টেশান মাষ্টারের  সাথে  আলাপ থাকায়  তাকে বলে রাখতেন কলকাতা থেকে  বাড়ির লোকজন আসছে ট্রেন  একটু বেশী  দাঁড়  করাবেন পুজোর  সামগ্রী, ফুলফল  সব নামানো হবে তাই।  তারপর  আমরা সবাই নেমে পড়তাম আর তারপর  ভ্যানে  বসে  যশড়া গ্রামে আমাদের  বাড়ি।  এখন  এই  ট্রেন যাত্রার আর  হয়  না এখন  নিজস্ব  গাড়ি  আথবা  ভাড়ার  গাড়ি  নিয়েই  পুজোর  সময়ে  সোমড়াবাজার  যাওয়া  হয়। 
   
আমাদের  বাড়ির পুজোর  অন্যতম বৈশিষ্ঠ  হলো  রথের দিন  নিজস্ব  বাঁশঝাড়  থেকে  বাঁশ কেটে  এনে  কাঠামো বেঁধে  কুলপুরহিতের তত্ত্বাবধানে  প্রতিমা তৈরির কাজ  শুরু  হয়। প্রথা মেনে  মহালয়ার  দিন  মায়ের  চক্ষুদান  হয়। ষষ্টীর  দিন  সন্ধ্যায়  পরিবারের  সদস্যদের  মধ্যে এক দম্পতি  জোড়  বেঁধে মা গঙ্গাকে  গিয়ে  আমন্ত্রন জানানো হয় ও তারপর  তারা মায়ের স্নানের  জল মাথায় করে   বাদ্যযন্ত্র  সহকারে  বাড়ি নিয়ে  আসা হয়।এরপর ঠাকুর দালানের পাশে  বেলতলায়  মায়ের  বোধন  শুরু  হয়। এরপর  প্রতিদিন  তিথি মেনে পুজোর  পাশাপাশি আমাদের পরিবারের আরও এক প্রাণপুরুষ ডাঃ শৈঁলেন্দ্র চন্দ্র সরকারের  রচনা করা মায়ের  গান  মা ' কে  শোনানো  হয়  সকলে  একত্রে ।  আমাদের বাড়ির পুজো বৈষ্ণব মতে  হওয়াতে  আমাদের  কোনও  বলি প্রথা নেই  এবং  আমাদের পুজোয় মা' কে  অন্নভোগ নয়,   ফল ভোগ ও লুচি সুজি ভোগ দেওয়া হয়। আমাদের পুজোর সন্ধিপুজো খুবই  আকর্ষনীয় ।  তারপর দশমীতে  আমাদের  আরও  একটি বৈশিষ্ঠ্য  আমাদের মায়ের  আশির্বাদ  নাচ ও গান সহযোগে  আমরা  গ্রামের  প্রতিটি বাড়িতে  নগরকীর্তনের  মাধ্যমে  ছড়িয়ে দেওয়া হয় ও বিকালে গঙ্গার ঘাটে  মা'য়ের বিদায়ী গান শুনিয়ে  বিসর্জনের মাধ্যমে  মাকে  বিদায়  জানানো  হয়। শেষ কয়েক বছর ধরে  আমরা পুজোর  সাথে  সাথে  কিছু  সামাজিক কাজ আমরা করছি আমাদের পরিবারের কল্লোল সরকারের  হাত ধরে। বস্ত্রদান ,কম্বলদান অষ্টমীতে  ভোগদান ,  বসে আকোঁ  প্রতিযোগিতা ,  ও  গ্রামের  কৃতি ছাত্রীদের সম্মান  জানানো , ছাতা  প্রদান ও পরিবারের  ছোট সদস্যের  প্রচেষ্ঠায় নানান অনুষ্ঠানের মাধ্যমে  আমাদের পুজোর প্রতিটি  দিন কাটে।
                  
বর্তমানে  কর্মসূত্রে  পরিবারের  অনেক  সদস্যকেই  বাইরে  থাকতে হয় কিন্তু পুজোর  কয়েকটি  দিন  আনন্দ উপভোগের জন্য ও মায়ের টানে  সমস্ত কাজ  ফেলে রেখে আমরা একত্রিত হই  সোমড়াবাজারে ।  এই  ভাবেই  দেখতে  দেখতে এই বছর  আমাদের বাড়ির পুজো  ৮১ বছরে  পা রাখছে আমাদের #সরকার_ভিলা_দুর্গোৎসব  । মায়ের  আশির্বাদ  মাথায়  নিয়ে  বংশ পরম্পরায়  এই  ভাবেই  এগিয়ে যেতে চাই  বছরের পর বছর ।।।। 
















ধন্যবাদ ।
ছবি সৌজন্যে - Subhrojyoti Sarkar, Subhajit Guha Biswas, Anushree Rudra, Moumita Basu, Sreetama Sarkar, Sanglap Sarkar
লেখায় সাহায্য করেছে- কৌণিক সরকার

Sunday, 20 September 2020

কর বাড়ির পুজো

 


করোনা সুরের করালগ্রাসে আজস্তব্ধ ভুবনএক অনিশ্চয়তার মধ্যেডুবে আছেমানবসমাজ, চারিদিকে মৃত্যুর ঢক্কানিনাদ্এমতাবস্থায় সকল দুঃখকষ্ট ভুলিয়ে দিতে পারে একমাত্র উমাইঘরের মেয়ের ঘরে ফেরার সময় আসন্নআর এত প্রতিকুলতার মাঝেও অন্যান্যবারের মতো উমার আদর যত্নে কোন ও ত্রুটি থাকবেনা ৬৩ বি নিমতলা ঘাট স্ট্রিটের" করবাড়ির"পূজোয়১৯৬৯ সালে স্বর্গীয় প্রফুল্লকুমার করের হাত ধরে উমা প্রথম আসে নিমতলা ঘাট স্ট্রীটের কর বাড়িতেসেদিন থেকে আজ অবধিপ্রায় ৫২বছর একই রকম নিষ্ঠাও স্নেহের সঙ্গে মাতৃ আরাধনা হয়ে আসছে এই ভিটেতে

মহাপঞ্চমীরপুণ্যলগ্নেকুমোরটুলিথেকেমাতৃপ্রতিমাআসেকরবাড়িতেএরপর সারাদিন ধরে চলে ঠাকুর দালান সাজিয়ে তোলার কাজবাড়ির প্রত্যেক সদস্য আনন্দের সঙ্গে সাজানোর কাজে এগিয়ে আসে |সবশেষে দেবীর পরনে ওঠে সোনালী ডাকের সাজএর কোনও অন্যথা হয়নাএকে একে সকল অস্ত্র দিয়ে সাজিয়ে তোলা হয় মহিষমর্দিনীদেবীও তারপুত্র কন্যাদের

এরপর মহাষষ্ঠীতে প্রথা মেনেই হয়দেবীর বোধন

আপনারা যারা অবগতনন এই করবাড়ির দূর্গাপূজা সম্বন্ধে, তাদের উদ্দশ্যে বলি, এই পূজোর একটা অন্যতম বিশেষত্ব হল, নবপত্রিকা স্নান। সপ্তমীর সকালবলতেই আমাদের চোখের সামনে যেছবিটা ভেসে ওঠে তাহলো ভোরের আলো ফোটার আগেই গঙ্গার ঘাটে নবপত্রিকা স্নানের দৃশ্যতবে এই কর বাড়ির নব পত্রিকা স্নান বাড়িতেই সারা হয় গঙ্গাজল এবং আর ওনানা উপাদান সহযোগেএই প্রথা এই পূজোরপ্রাণ পুরুষ স্বর্গীয় প্রফুল্ল কুমার করই কায়েম করে গেছেন

 

পূজোর প্রতিদিন অর্থাৎ ষষ্ঠী থেকে নবমী পর্যন্ত তিন রকম ভাজা, লুচি আর মিষ্টান্ন সহযোগে মাকে ভোগ উৎসর্গ করা হয়আর অষ্টমী নবমীর সন্ধিক্ষণে, অর্থাৎ সন্ধিপূজোর সময় এক মন চালে রবি শেষ নৈবেদ্য অর্পণ করা হয়। প্রতিদিন অত্যন্ত নিষ্ঠাও ধুমধামের সাথে সকল আচার অনুষ্ঠান পালন করে কর পরিবারশুধু পরিবারের লোকজনই নন, বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজনও পাড়াপ্রতিবেশী সকলে অংশ নেন করবাড়ির মাতৃ আরাধনায়। অষ্টমীপূজোর অঞ্জলি দিতে বহু মানুষ ভিড় জমান এই ঠাকুর দালানে। তবে এবছরের পরিস্থিতি মাথায় রেখে করোনা সতর্কমূলক সমস্ত রকম আয়োজন সেরে রাখা হচ্ছেতার সাথে অঞ্জলির সময় ভিড় এড়ানোর জন্য একসাথে বেশি সংখ্যক মানুষকে দালানে প্রবেশের অনুমতি দেওয়া হবেনা

 পাঁচদিন মহাধুমধামের পর আসে দশমীর বিদায়বেলা। বেজে ওঠে বিষাদের সানাই

এই দিন সকল কাজে অপরাজেয় হওয়ার উদ্দেশ্যে অপরাজিত গাছের পূজার চল রয়েছে কর বাড়িতেএরপর সূর্যাস্তের পরবিদায় ঢাকের বোলে মায়ের বিসর্জনহয় নিমতলা গঙ্গার ঘাটে

আবারও ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরার অপেক্ষায় দিন গোনে "করভিটে"তবে এবছর বিদায় বেলায় মায়েরকাছে একটা বিশেষ আবদার নিশ্চয়ই থাকবেমা যেন এই দুঃসময়কে কাটিয়ে ওঠার শক্তিও শুভ চেতনা আমাদের সকলকে দিয়ে যান

 








https://www.facebook.com/KAR-BARIR-PUJA-1565077046855788/